পেয়ারা (Psidium guajava) বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ফল। এটি কেবল পুষ্টিকর ও সুস্বাদু নয়, বরং স্বল্প খরচে বেশি ফলন পাওয়া যায় বলেই কৃষকদের কাছে অন্যতম পছন্দ। পেয়ারা গাছের পরিচর্যার মাধ্যমে উচ্চ ফলন এবং লাভজনক চাষ সম্ভব। এই গাইডে আমরা পেয়ারা গাছের উন্নত জাত, উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি, চারা রোপণ, সার ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক কৃষিপদ্ধতি এবং বাণিজ্যিক সম্ভাবনার বিস্তারিত আলোচনা করব।






উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি
পেয়ারা গাছ সাধারণত গরম ও আর্দ্র জলবায়ুতে ভালো জন্মে। তবে এটি কিছুটা শুষ্ক পরিবেশেও মানিয়ে নিতে পারে।
- তাপমাত্রা: ২০°C থেকে ৩০°C সর্বোত্তম
- বৃষ্টিপাত: বার্ষিক ১০০০ – ২০০০ মিমি
- মাটি: দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটি সর্বোত্তম। pH ৫.৫ – ৭.০
পানি জমে না এমন উঁচু জমি পেয়ারা চাষের জন্য উপযুক্ত। জলাবদ্ধতা মূল পচা রোগ সৃষ্টি করে এবং গাছের উৎপাদন ব্যাহত করে।
উন্নত জাত নির্বাচন
সঠিক জাত নির্বাচন ফলনের গুণগত মান নির্ধারণ করে। বাংলাদেশে এখন বেশ কিছু উন্নত জাত চাষ হচ্ছে:
- বারি পেয়ারা-১: মাঝারি আকৃতির, সাদা শাঁসযুক্ত, অত্যন্ত মিষ্টি।
- বারি পেয়ারা-৪: বড় ফল, পাতলা খোসা, বাজারে বেশি চাহিদা।
- কাশ্মীরি পেয়ারা: গোলাপি শাঁসযুক্ত, দৃষ্টিনন্দন ও সুস্বাদু।
- তাইওয়ান পেয়ারা: বড় আকার, রোগপ্রতিরোধী এবং অধিক ফলনশীল।
- স্বর্ণজয়ন্তী: বারোমাসি জাত, বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক।
চারা প্রস্তুতি ও রোপণের পদ্ধতি
সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ এবং জুন-আগস্ট মাসে পেয়ারার চারা রোপণ করা হয়। রোপণের সময় নিচের নিয়মগুলি অনুসরণ করা উচিত:
- গর্ত খোঁড়া: ৬০ সেমি × ৬০ সেমি × ৬০ সেমি মাপের গর্ত খনন করুন।
- গর্তের প্রস্তুতি: প্রতি গর্তে ১০-১৫ কেজি পচা গোবর, ১ কেজি চুন, ১০০ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা মিশিয়ে ১০ দিন রেখে দিন।
- চারা রোপণ: সুস্থ, রোগমুক্ত চারা সকালে বা বিকেলে রোপণ করুন।
- দূরত্ব: সারি ও গাছের মাঝে ৩ মিটার × ৩ মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন।
সার ব্যবস্থাপনা
সঠিক সার ব্যবস্থাপনা ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে গাছের বয়স অনুযায়ী সারের পরিমাণ দেওয়া হলো:
বয়স | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | গোবর (কেজি) |
---|---|---|---|---|
১ বছর | ২৫০ | ২০০ | ১৫০ | ১০ |
২–৩ বছর | ৫০০ | ৪০০ | ৩০০ | ১৫–২০ |
৪ বছর বা তার বেশি | ৭৫০ | ৫০০ | ৪০০ | ২০–২৫ |
সার দুই ধাপে দিন: বর্ষার শুরুতে এবং ফল তোলার পর। জৈব সার ব্যবহারে মাটির উর্বরতা ও ফলের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
সেচ ব্যবস্থাপনা
গ্রীষ্মকালে ১৫-২০ দিন অন্তর সেচ প্রয়োজন। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে তা দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
ছাঁটাই ও গাছের আকার গঠন
ফল সংগ্রহের পর পর গাছের ডাল ছাঁটাই করতে হবে। এতে নতুন শাখা গজায় ও ফলন বাড়ে।
- মরা ও দুর্বল ডাল কেটে ফেলুন।
- মাঝখানের ঘন ডালগুলো পরিষ্কার করে আলো-বাতাস প্রবেশ নিশ্চিত করুন।
রোগ ও পোকামাকড় প্রতিকার
পেয়ারা গাছে কিছু সাধারণ রোগ ও পোকা দেখা যায়। প্রতিকার নিচে দেওয়া হলো:
- ফলমাছি: ফলের মধ্যে ডিম পাড়ে ও পচিয়ে ফেলে। প্রতিকার: ফেরোমন ট্র্যাপ, ডেল্টা ট্র্যাপ ব্যবহার করুন।
- পাতা মোড়ানো পোকা: পাতাকে রোল করে খেয়ে ফেলে। প্রতিকার: সাইপারমেথ্রিন ০.৫% স্প্রে করুন।
- জাবপোকা: পাতার রস শোষণ করে। প্রতিকার: ইমিডাক্লোপ্রিড স্প্রে।
- পাতার দাগ রোগ (Anthracnose): বাদামি/কালো দাগ হয়। প্রতিকার: কপার অক্সিক্লোরাইড বা ম্যানকোজেব স্প্রে করুন।
- মূল পচা রোগ: অতিরিক্ত পানির কারণে হয়। প্রতিকার: নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন এবং ট্রাইকোডার্মা ব্যবহার করুন।
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
সাধারণত চারা রোপণের ২-৩ বছরের মধ্যে ফল আসে।
- ফল সংগ্রহ: আগস্ট-অক্টোবর ও ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে পাকা ফল সংগ্রহ করুন।
- পরিচিতি: ফল সবুজ থেকে হালকা হলুদ রঙ ধারণ করলে তা সংগ্রহযোগ্য।
- সংরক্ষণ: ঠাণ্ডা, শুষ্ক ও বায়ু চলাচলযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করুন।
আধুনিক কৃষিপদ্ধতি ও প্রযুক্তি
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার পেয়ারা চাষকে আরও ফলনদায়ক করে:
- ড্রিপ ইরিগেশন: পানি সাশ্রয় করে নির্দিষ্ট এলাকায় জল সরবরাহ করে।
- মালচিং: আগাছা নিয়ন্ত্রণ করে ও মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখে।
- ফেরোমন ট্র্যাপ: পোকামাকড় দমনে প্রাকৃতিক উপায়।
- জিপিএস/ড্রোন ব্যবহার: গাছ পর্যবেক্ষণ, সারের মান নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
- ডিজিটাল অ্যাপ: কৃষি তথ্য, আবহাওয়া পূর্বাভাস, রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করে।
বাণিজ্যিক চাষ ও বাজার সম্ভাবনা
বাংলাদেশে পেয়ারা চাষ একটি সম্ভাবনাময় খাত। অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে কাশ্মীরি এবং বারি-৪ জাতের পেয়ারার চাহিদা বাড়ছে।
- বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে উন্নত জাত, জৈব সার ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার অপরিহার্য।
- স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অফিস, বেসরকারি কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
- মার্কেটিং চেইন, রপ্তানি সংযোগ, এবং ব্র্যান্ডিং পদ্ধতিগুলি শিখে বড় আকারে উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।
উপসংহার
পেয়ারা গাছের সঠিক পরিচর্যা, উন্নত জাত নির্বাচন, সুনির্দিষ্ট সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা পেয়ারা চাষে অধিক লাভবান হতে পারেন। এই ফলটি যেমন পুষ্টিকর, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে পেয়ারা চাষ বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।