Table of Contents

আঙ্গুর (Grapes) একটি সুস্বাদু, রসালো এবং পুষ্টিকর ফল যা আমাদের দেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেকে মনে করেন যে এটি শুধুমাত্র শীতপ্রধান দেশের ফল, কিন্তু বাস্তবতা হলো – সঠিক নিয়মে পরিচর্যা করলে আমাদের দেশের আবহাওয়াতেও খুব ভালোভাবে আঙ্গুর চাষ করা যায়। এই গাইডে আপনি আঙ্গুর গাছের চারা রোপণ, সঠিক পরিচর্যা, পাতার যত্ন, ফুল ফোটানো এবং ফল ধরার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

আঙ্গুর গাছ চাষের উপযুক্ত সময় ও আবহাওয়া

বাংলাদেশে আঙ্গুর চাষের জন্য নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময় উপযুক্ত। এই সময়ে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে, যা আঙ্গুর গাছের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী। গ্রীষ্মকালেও কিছু জাত ভালো ফল দেয়, তবে ফলের গুণগত মান কিছুটা কমে যেতে পারে।

আঙ্গুর গাছের উপযুক্ত মাটি

আঙ্গুর চাষের জন্য দোঁআশ বা বেলে-দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটিতে পানি জমে থাকা যাবে না, তবে হালকা আর্দ্রতা থাকা জরুরি। মাটির pH মান ৬.৫ – ৭.৫ হলে গাছ ভালো বৃদ্ধি পায়।

আঙ্গুরের চারা নির্বাচন ও রোপণ পদ্ধতি

চারা নির্বাচন করার সময় রোগমুক্ত, সবল ও শক্ত ডালযুক্ত চারা নির্বাচন করতে হবে। ১ থেকে ১.৫ ফুট উচ্চতার চারা বেছে নিন।

রোপণ পদ্ধতি:

  • চারা রোপণের আগে ১.৫ x ১.৫ x ১.৫ ফুট গর্ত তৈরি করুন।
  • গর্তে ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম এমওপি ও কিছু ছাই মিশিয়ে নিন।
  • চারা রোপণের পর পানি দিন এবং গাছের পাশে একটি খুঁটি দিন যাতে গাছ লতা আকারে উঠতে পারে।

আঙ্গুর গাছের পরিচর্যার সঠিক নিয়ম

১. পানি দেওয়া

গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দিতে হবে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন গাছের গোড়ায় পানি জমে না থাকে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

২. সার প্রয়োগ

আঙ্গুর গাছে ফল আসার জন্য সঠিকভাবে সার ব্যবহার করতে হবে। নিচের মত একটি সার ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করুন:

  • ৩ মাস পরপর ১০ কেজি গোবর সার
  • ১ বছরে ৩ বার: ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম এমওপি
  • জৈব সার: ভার্মিকম্পোস্ট বা কম্পোস্ট সার গাছের চারপাশে ব্যবহার করুন

৩. গাছ ছাঁটাই

প্রতি বছর গাছ ফল ধরার পর ছাঁটাই করা উচিত। পুরনো, রোগাক্রান্ত এবং শুষ্ক ডালগুলো কেটে ফেলুন। এতে নতুন কুঁড়ি গজায় এবং বেশি ফল আসে।

৪. মাচা তৈরি

আঙ্গুর গাছ লতানো হওয়ায় মাচা তৈরি করা জরুরি। মাচার সাহায্যে গাছ ছড়িয়ে পড়ে এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায়। এতে ফলনের মান ও পরিমাণ দুটোই বাড়ে।

পাতা ও ফুলের যত্ন

১. পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া

আঙ্গুর গাছের পাতা হলুদ হয়ে গেলে বুঝতে হবে এটি পুষ্টির অভাবে হয়েছে বা অতিরিক্ত পানি দেওয়ার কারণে শিকড় পচে গেছে। এই অবস্থায়:

  • জৈব সার ব্যবহার করুন
  • পানি দেওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ রাখুন
  • পাতায় তরল সার স্প্রে করুন (যেমন: মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট)

২. ফুল ঝরে যাওয়া

ফুল ঝরে যাওয়া একটি সাধারণ সমস্যা, বিশেষ করে অনুপযুক্ত আবহাওয়া বা পুষ্টির অভাবে। প্রতিকার:

  • ফুল আসার সময় গাছে ইউরিয়া ও এমওপি সার ব্যবহার করুন
  • পাতায় বোর্ন সার স্প্রে করুন
  • পোকামাকড় থেকে গাছ রক্ষা করুন

পোকামাকড় ও রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ

আঙ্গুর গাছে অনেক ধরনের পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারে যেমন:

  • লাল মাকড়সা: পাতার নিচে বসবাস করে এবং পাতার রঙ পাল্টে দেয়
  • থ্রিপস: ফুল ও পাতায় ক্ষত করে
  • ডাউনি মিলডিউ: একটি ছত্রাকজনিত রোগ যা পাতায় দাগ ফেলে

প্রতিরোধের উপায়:

  • নিয়মিত নিটোল বা নিলেট স্প্রে করুন
  • জৈব বালাইনাশক যেমন নিম তেল ব্যবহার করুন
  • পাতার নিচে নিয়মিত পরীক্ষা করুন

ফুল থেকে ফল – ফলন বৃদ্ধি করার কৌশল

আঙ্গুর গাছে ফুল আসার পর ফল ঠিকভাবে ধরে না – এমন সমস্যা অনেকেই ফেস করে। নিচে কিছু কার্যকর কৌশল দেওয়া হলো:

  • ফুল আসার সময় পাতায় বোরন সার স্প্রে করুন
  • মাটিতে সামান্য ফসফরাস ও পটাশ মেশান
  • পর্যাপ্ত সূর্যালোক নিশ্চিত করুন
  • গাছের নিচে পানি জমে থাকতে দেবেন না

ফল সংগ্রহের সময় ও পদ্ধতি

চারা রোপণের ১০-১২ মাস পর গাছে প্রথম ফল আসে। ফুল আসার প্রায় ৯০-১২০ দিন পর ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল সম্পূর্ণ পাকা হলে তা কিছুটা নরম ও রসালো হয়।

ফল সংগ্রহ করার সময়:

  • শুধু পাকা গুচ্ছগুলো কাটুন
  • ধারালো কাঁচি ব্যবহার করুন
  • ফলের গায়ে আঘাত লাগানো থেকে বিরত থাকুন

উপসংহার

সঠিক নিয়মে পরিচর্যা করলে আঙ্গুর গাছ খুব সহজেই ফল দিতে শুরু করে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে ফুল ও ফল পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে যত্ন নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে ছাঁটাই, মাচা তৈরি, সার ব্যবস্থাপনা এবং রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণে সচেতন থাকলে একটি গাছ থেকে বছরে ২০-৩০ কেজি পর্যন্ত ফল পাওয়া সম্ভব।

আপনি যদি বাসায় বা বাগানে আঙ্গুর চাষ করতে চান, তাহলে এই গাইডটি অনুসরণ করুন এবং আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের জানাতে ভুলবেন না!